কাজী নজরুল ইসলামের ‘কামাল পাশা’


(কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা কাব্য গ্রন্থ থেকে)

ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল-সামাল তাই!
       কামাল! তু নে  কামাল কিয়া ভাই !
হো হো কামাল ! তু নে  কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার মেজর মার্চ্চের হুকুম করিলঃ-কুইক মার্চ্চ! )

        লেফট্! রাইট্! লেফট্!!
        লেফট্! রাইট্! লেফট্!!

  ( সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ্চ করিতে লাগিল )


ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!
  কামাল! তু  নে  কামাল কিয়া ভাই!
 হো  হো কামাল! তু নে  কামাল কিয়া ভাই!


  (হাবিলদার  মেজরঃ- লেফট্!রাইট্!  )

সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শমশেরে|
পাঠিয়ে দিলি দুষমনে সব  যম-ঘর  একদম্-সে রে!
       বল্ দেখি ভাই, বল হাঁ রে,
দুনিয়ায় কে ডর্ করে না তুর্কীর তেজ্ তলোয়ারে?

  (লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

       খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!
বুজদিল ঐ দুশমন্ সব বিলকুল্ সাফ হো গিয়া!
       খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া,
          হুররো হো!
         হুররো হো!
দস্যুগুলোয় সামলাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার  মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

শির  হ'তে  পাঁও তক্  ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে
         রণ-ভীতুদের শান্তি-বাণী শুন্ বে কে ?
             পিন্ডারীদের খুন-রঙীন
         নোখ-ভাঙা এই নীল সঙীন
 তৈয়ার হেয়্ হর্দ্দম ভাই ফার্ তে যিগর্ শত্রুদের!
  হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ্ তোদের!
       সাবাস্ জোয়ান্! সাবাস্!
 ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্-
         এমনি ক’রে রে-
         এমনি জোরে রে-
 ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!
  ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আস্ মানে আজ রক্ত-রবির আভাস!
       সাবাস্ জোয়ান্! সাবাস্!!

        (লেফট্! রাইট্! লেফট্!)


হিংশুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,
তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ,  আমরা মোটেই  হই  নি জের!
      পরের মুলুক লুট ক’রে খায় ডাকাত তারা ডাকাত!
তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!
            কি বল ভাই শ্যাঙাত ?
              হুররো হো!
              হুররো হো!
দনুজ-দলে দ’লতে দাদা এমনি দামাল কামাল চাই!
       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!


(হাবিলদার  মেজর :- রাইট্ হুইল্! লেফট্! রাইট্! লেফট্!
          সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল|)



আজাদ মানুষ বন্দী ক’রে , অধীন ক’রে স্বাধীন দেশ,
কুল্ মুলুকের কুষ্টি ক’রে জোর দেখালে ক’দিন বেশ,
মোদের হাতে তুর্কী-নাচন নাচলে তাধিন্ তাধিন্ শেষ!
            হুররো হো!
            হুররো হো!

বদ্-নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই ক’রলে কি না আল্লায়,
পিশাচগুলো প’ড়ল এসে পেল্লায় এই  পাগলাদেরই পাল্লায়!
      এই পাগলাদেরই পাল্লায়!
        হুররো হো!
        হুররো-
ওদের কল্লা দেখে আল্লা ডরায়,  হল্লা  শুধু  হল্লা,
.          ওদের হল্লা শুধু হল্লা,
এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধ’রতে আসেন তুর্কী তাজী,
        মর্দ্দ গাজী মোল্লা!
        হাঃ! হাঃ! হাঃ!
      হেসে নাড়ীই ছেঁড়ে বা!
      হা হা হাঃ! হাঃ! হাঃ!

  (হাবিলদার-মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্ ! লেফট্!
          সাবাস্ সিপাই! ফের বল ভাই|)


ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল  সামাল  তাই!
     কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
    হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার-মেজরঃ- লেফট্ হুইল! য়্যাজয়ু ওয়্যার্! রাইট্ হুইল!-
         লেফট্! রাইট্! লেফট্!)
(সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।)


    দেখচ কি দোস্ত্ অমন ক’রে? হৌ  হৌ  হৌ!
সত্যি তো ভাই! সন্ধ্যেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ।
   শহীদ সেনার টুকটুকে বৌ লাল-পিরাহাণ- পরা,
  স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগ্ ডগে আন্ কোরা!-
 না না না,-কলজে’ যেন টুকরো-ক’রে  কাটা
হাজার তরুণ শহীদ বীরের,-শিউরে উঠে গা’টা!
আসমানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই!
দেখতে পেলে এক্ষুণি গ্যে এই ছোরাটা কলজেতে তার বসাই!
          মুন্ডুটা তার খসাই!
গোস্বাতে আর পাইনে ভেবে কি যে করি দশাই!
(হাবিলদার মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্! লেফট!)


[ঢালু পার্ব্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া
সন্তর্পণে নামিল!]

        আহা কচি ভাইরা আমার রে!!
এমন কাঁচা জানগুলো, খান্ খান্ ক’রেছে কোন্ সে চামার রে?
      আহা কচি ভাইগুলো আমার রে!!

[সামনে উপত্যকা! হাবিলদার-মেজর:- লেফট্  ফর্ম্ম্|)
সৈন্য-বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল!হাবিলদার-মেজর:-ফরওয়ার্ড!
       লেফট! রাইট্! লেফট্!]


          আসমানের ঐ আঙরাখা
          খুন-খারাবীর রং-মাখা
          কি খুবসুরৎ বাঃ রে বা!
          জোর বাজা ভাই কাহার্ বা!
        হোক্ না ভাই এ কারবালা ময়দান-
        আমরা যে গাই সাচ্চারই জয় গান!
        হোক্ না এ তোর কারবালা ময়দান!!
               হুররো হো
               হুররো-

[সামনে পার্ব্বত্য পথ-হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে| হাবিলদার-মেজর
পথ খুঁজতে লাগিল| হুকুম দিয়া গেলঃ-“মার্ক টাইম”! সৈন্যগণ এক স্থানেই
দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল-]


             দ্রাম্! দ্রাম! দ্রাম!
             লেফট্! রাইট্!  লেফট্!
             দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম্!
আসমানে ঐ ভাসমান যে মস্ত দুটো রং-এর তাল,
একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,-
     বুঝলে ভাই! ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের!
     দেখ্ তে নারে কারুর ভালো,
তাইতো কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের |
          হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!
   গৃধু ওরা, লুব্ধ-ওদের লক্ষ্য অসুর বল-
          হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!
          জালিম ওরা অত্যাচারী!
   সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই!
          জালিম ওরা অত্যাচারী!
          সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই-
          জোর অপমান ক’রলে ওরাই,
তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল!-
           ওরা হিংস্র পশুর দল!
           ওরা হিংস্র পশুর দল!!

[হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল|ঃ-ফরওয়ার্ড! লেফট্ হুইল-
           সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল-লেফট্! রাইট! লেফট্!]


      সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হ’ল মরে!
      তোদের মতন পিঠ ফেরে নি প্রাণটা হাতে ক’রে,-
            ওরা  শহীদ হ’ল ম’রে!
       পিটনি খেয়ে পিঠ যে তোদের টিট্ হ’য়েছে! কেমন!
      পৃষ্টে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন!
            মুর্দ্দারা সব যুদ্ধে আসিস্! যা যা!
খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টক্ টকে লাল কেমন গরম তাজা!
           
[বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল]


              মুর্দ্দারা সব যা যা!!
            এঁরাই বলেন হবেন রাজা!
            আরে যা যা! উচিত সাজা
          তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই!

         [ হাবিলদার-মেজরঃ- সাবাস সিপাই!]


          এই তো চাই! এই তো চাই!
থাকলে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই!
             এই তো চাই!!

[কতকগুলি লোক অশ্রু পূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল,
         তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল!]

               
              মার দিয়া ভাই মার্ দিয়া!
              দুশমন্ সব হার্ গিয়া!
              কিল্লা ফতে হো গিয়া!
              পরওয়া নেহি , যা’নে দো ভাই যো গিয়া!
                কিল্লা ফতে হো গিয়া!
                হুররো হো!
                হুররো হো!

[হাবিলদার-মেজরঃ-সাবাস্ জোয়ান! লেফট্! রাইট্!]


               জোর্’সে চলো পা মিলিয়ে,
               গা হেলিয়ে,
               এমনি ক’রে হাত দুলিয়ে!
            দাদরা তালে ‘এক দুই তিন’ পা মিলিয়ে
               ঢেউ-এর মতন যাই!
       আজ স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্ তও না চাই!
             আর বেহেশতও না চাই!!

[হাবিলদার-মেজরঃ-সাবাস্ সিপাই!! ফের বল ভাই!]


ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!
       কামাল! তু নে কামাল  কিয়া ভাই!
হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল| নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া
এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহাদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত| আজ বধুর মুখের
বোরকা খুলিয়া পড়িয়াছে| ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা
করিতেছিল| সৈন্যগণ চীত্কার করিয়া উঠিল|]



    ঐ শুনেছিস্? ঝরকাতে সব বলছে ডেকে বৌ-দলে,
      “কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?”
চিনিস্ নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!-কামাল এ যে কামাল!!
       পাগলী মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!
       তা না হ’লে কার হবে আর রৌশন এমন জামাল?
             কামাল এ যে কামাল!
      উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ী সব সামাল!
             ঘর-বাড়ী সব সামাল!
      আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ ঠুটেছে|
             ডগ্ মগিয়ে জোশ উঠেছে|
             সামনে থেকে পালাও!
      শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্ ঘরে দীপ জ্বালাও!
             সামনে থেকে পালাও!
             যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!!

 [হাবিলদার-মেজরঃ-লেফ্ ট ফর্ম্ম! লেফট্ রাইট্! লেফট্!-ফরোয়ার্ড!)

বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল| পার্শ্বেই পরিখার সারি| পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের
দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙ্গাইয়া ডিঙ্গাইয়া চলিতেছে!]



       ইস্! দেখেছিস্! ঐ কা’রা ভাই সামলে চলেন পা,
       ফ’সকে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!
       ও তাই শিউরে ওঠে গা!
                হাঃ হাঃ হাঃ!
           ম’রলো যে সে ম’রেই গেছে,
           বাঁচলো যারা রইল বেঁচে!
       এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি আর আঃ?
      মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ!
            হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

[সন্মুখে সঙ্কীর্ণ  ভগ্ন সেতু| হাবিলদার মেজর অর্ডার দিলেন-“ফর্ম্ম ইনটু সিঙ্গল লাইন!”
এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহতদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পনে
“শ্লো মার্চ্চ” করিয়া পার হইতে লাগিল|]



              সত্যি কিন্তু ভাই!
যখন মোদের বক্ষে বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই-
       কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!
       কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কলজেখানা পেষে!
নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে’ তখন ডুকরে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!
             কে যেন ভাই কলজেখানা পেষে!!
   
         ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!!
       বুকে যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,
                 যতই বলি বাহা!
            লক্ষীমণি ভাইটি আমার, আহা!!
        ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পারের ভাইটি আমার, আহা!!
    অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা,
      ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা!
       মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!
       আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!
                  হতভাগা রে!
         ম’রেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগারে!
       না জানি কোন্ ফুটতে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়!
তরুণ জীবন এমনি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!
               তরুন খুনের তরুন শহীদ! হতভাগা রে!
               ম’রেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে !
তাই যত আজ লিখনে-ওয়ালা তোদের মরণ, ফূর্ত্তি-সে জোর লেখে
      এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু কথা! হাসি রকম দেখে!
      ম’রলে  কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!
                       খবর  বেরোয় দৈনিকে,
    আর একটি কথায় দুঃখ জানান, “জোর ম’রেছে দশটা হাজার সৈনিকে!”
       আঁখির পাতা ভিজলো কি না কোনো কালো চোখের,
    জানলো না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!
    প’চে মরিস্ পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে ‘বাহা’!
   সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথায় ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!-
       আয় ভাই তোর বৌ এলো ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত চেলী পরে,
    আঁধার-শাড়ী প’রবে এখন প’শরে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!-
        ভাবতে নারি, গোরের মাটি ক’রবে মাটি এ মুখ কেমন ক’রে-
               সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!
          বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো!
         অনাদরের ভাইটি আমার! মাটীর মায়ের কোলে এবার ঘুমো!!

[নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোর মার্চ্চ করিতে করিতে
তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল|]


                  ঠিক ব’লেছ দোস্ত তুমি!
                চোস্ত কথা! আয় দেখি তোর হস্ত চুমি!
              মৃত্যু এরা জয় ক’রেছে কান্না কিসের?
       আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কলসী বিষের!
              কে ম’রেছে? কান্না কিসের?
                   বেশ ক’রেছে!!
              দেশ বাঁচাতে আপনারি জান শেষ ক’রেছে!!
                                বেশ করেছে!!
                               শহীদ ওরাই শহীদ!
               বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত!
                                শহীদ ওরাই শহীদ!!

[এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল| মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্য সামন্ত ও সৈনিকের
আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে
আত্মহারা হইয়া “ডবল মার্চ্চ” করিতে লাগিল|]


                 হুররো হো!
                 হুররো হো!!
     ভাই-বেরাদর পালাও এখন! দূর্ রহো! দূর রহো!!
               হুররো হো! হুররো হো!

      [কামাল পাশাকে কোলে লইয়া নাচিতে লাগিল|]


          হৌ হৌ হৌ! কামাল জিতা রও!
            কামাল জিতা রও!
         ও কে আসে? আনোয়ার ভাই?-
        আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ্!!
       জোর নাচো ভাই! হর্দ্দম্ দাও লাফ্!
           আজ জানোয়ার সব সাফ্!
         হুররো হো! হুররো হো!!

সবকুছ্ আব্ দূর্ রহো!-হুররো হো! হুররো হো!!
রণ জিতে জোর মন মেতেছে!- সালাম সবায় সালাম!-
              নাচনা থামা রে!
জখমী ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে!
              নাচ্ না থামা রে!

           [আহতদের নামাইতে নামাইতে]


          কে ভাই? হাঁ, হাঁ, সালাম!
-ঐ শোন্ শোন্ সিপাহ্-সালার কামাল-ভাই-এর কালাম!
     
           [সেনাপতির অর্ডার আসিল]


           “সাবাস্! থামো! হো হো!
           সাবাস্! হল্ট্! এক! দো!!”

[এক নিমেষে সমস্ত কলরোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল! তখনো কিন্তু তারায় তারায় যেন ঐ বিজয়-
গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে  ক্ষীণ তর হইয়া মিলিয়া গেল।]


ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই!
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!
           কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
   হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!


কাজী নজরুল ইসলাম: (মে ২৪, ১৮৯৯–আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬–ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালী মণীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন নজরুল। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।

Post a Comment

Previous Next

نموذج الاتصال