॥ উৎপল কান্তি ধর ॥
বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের যারা অংশভাক্, সমগ্র জীবন যারা উৎসর্গ করেছেন স্বদেশের মুক্তি, কল্যাণ ও হিতব্রতে, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যাপৃত থেকেছেন জীবনভর - মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন তাঁদেরই অন্যতম। নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যে সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের এক সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণই ছিল নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই মহৎ লক্ষ্যেই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে।
নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন ব্যতিক্রমী এক মানুষ। চিরাচরিত সংসার ও গার্হস্থ্য জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে নিজেকে যিনি বিলিয়ে দিয়েছেন স্বদেশের মুক্তি, কল্যাণ ও হিতব্রতে। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে উঠে মনুষ্যত্বের মানবিক সাধনায় জীবনভর ব্যাপৃত করেছেন নিজেকে। স্বদেশের জন্যে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমৃদ্ধ এক ভবিষ্যৎ রচনার স্বপ্নে, সকল মানুষের জন্যে সমঅধিকার, সমমর্যাদার এক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন সাচ্চা ও খাঁটি এক মানুষ, সমকালে যা একান্ত বিরল।
মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের জন্ম জামালপুর সদর উপজেলার পাঁচগাছি গ্রামে, তাঁর মাতুলালয়ে, ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১০ জ্যৈষ্ঠে। গান্ধীবাদী পিতার কাছ থেকে একান্ত কৈশোরে স্বদেশ চেতনার যে বীজমন্ত্রে তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন, ২০০৭ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর মুক্তি সাধনার সেই হিতব্রত থেকে বিচ্যূত হননি কখনো। নানা নিপীড়ন ও প্রতিকূলতা তাঁর সংকল্প ও বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া অসামান্য চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য ও দৃঢ়তার গুণে স্বদেশ-সাধনার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। তাঁর পিতৃনিবাস জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া গ্রামে। স্বর্ণ প্রসবিনী মাতা আছিরন বিবি। রাজিয়া ছিলেন চিরকুমারী।
নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন তাঁর পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পাঁচ ভাই-বোনদের মাঝে তিনি ছিলেন বড়। তাঁর অনুজ ভাই মোয়াজ্জেম হোসেনও ছিলেন স্বদেশব্রতের সাধনায় নিরলস এক কর্মী, গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জামালপুর মহকুমা কৃষক সমিতির দীর্ঘকালীন সভাপতি। ১৯৯৬ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। বোনদের মধ্যে জীবননেসা ও গুলবদনও বেঁচে নেই। পাঁচ ভাইবোনের স্মৃতি বহন করে কেবল বেঁচে আছেন বোন জাহানারা।
সেকালে, প্রতিকূল রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি রাজিয়া। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। কিন্তু, স্বদেশী আন্দোলনে উৎসর্গিতপ্রাণ কংগ্রেসী পিতার প্রেরণায় নিজ গৃহেই চালিয়ে যান নিরন্তর পড়াশোনার পালা। সত্যিকার অর্থেই স্বশিক্ষিত, প্রগতিশীল ও আধুনিকমনস্ক ছিলেন তিনি। তাঁদের পারিবারিক পাঠাগারটি ছিল সমৃদ্ধ ও বিশাল।
পিতার প্রেরণায় ও আগ্রহে মাত্র ১২ বছর বয়সেই জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেন রাজিয়া। পিতার হাত ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। দেশে ইংরেজ শাসন অবসানের লক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেতেন পিতার সঙ্গে, একান্ত কৈশোরেই। সে কারণে, রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে নাস্তিক অপবাদসহ নানা হুমকি সইতে হয় তাঁকে। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরূপে দেশের বিভিন্নস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সাইকেল চালিয়েও তিনি বহু সভায় যোগ দিয়েছেন। সে সময়ে তা ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের অন্যতম যুগ্মসম্পাদকরূপে সে সময়ে জামালপুর অঞ্চলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরার রায়পুরে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন রাজিয়া, তাঁর পিতার সঙ্গে। এই অধিবেশনে জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুসহ বহু বিশিষ্ট নেতাকে কাছ থেকে দেখা এবং তাঁদের কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জামালপুর শহরে এলে তাঁর সঙ্গে সাগ্রহে দেখা করে দেশে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে তাঁর কাছ থেকে দিকনিদের্শনা চান রাজিয়া। স্বকীয় যোগ্যতার গুণে মাত্র ১৪ বছর বয়েসেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পরাধীন ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমোচনে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বৈপ্লবিক পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনে বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’ প্রভাব ফেলে তাঁর ওপর, তাঁর পিতার মতোই। পিতা নাসির সরকারও ছিলেন ‘যুগান্তর’ অনুসারী।
বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমোচন এবং উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পথরেখা ধরে ১৯৩৪ সালে গড়ে ওঠে গান্ধী আশ্রম - জামালপুরের হাজীপুর বাজারে, ঝিনাই নদীর তীরে। উদ্যোক্তা রাজিয়ার দেশব্রতী পিতা নাসির সরকারসহ স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহৎপ্রাণ কিছু মানুষ। রাজিয়া খাতুন ছিলেন আশ্রমের অন্যতম পরিচালক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামালপুর অঞ্চলের মানুষকে পরাধীনতার গ্লানি মোচনের অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে হাজীপুরের এই গান্ধী আশ্রম। সেই সঙ্গে স্বদেশের কল্যাণসাধনায় নানান শুভ কর্মপ্রচেষ্টা শুরু হয় গান্ধী আশ্রমে। দেশজুড়ে পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশের হিতব্রতের মন্ত্রে উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত মানুষের এক কেন্দ্র হয়ে ওঠে গান্ধী আশ্রম। গান্ধী আশ্রমের বিবিধ কার্যক্রমের মধ্যে ছিল - চরকা কাটা, খাদি কাপড় বোনা, হস্তশিল্পজাত নানান সামগ্রী তৈরি, ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কাজকর্ম, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা, পাঠাগার ও শরীরচর্চা। সর্বোপরি ছিল স্বদেশপ্রেমের দীক্ষা। সে সময়ে গান্ধী আশ্রমে হিন্দু-মুসলিম ছাত্রী ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাদেরই একজন চিকিৎসক হালিমা খাতুন। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় এক চিকিৎসক। তিনি বলেন, আমি গান্ধী আশ্রমেরই সৃষ্টি।
পিতা নাসির সরকার এবং কন্যা রাজিয়া ছিলেন গান্ধী আশ্রমের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যমণি। গান্ধী আশ্রমের বিবিধ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন রাজিয়া এবং তাঁর কর্মীদল। মা ও প্রসূতি সেবা দেওয়া ছিল তাঁদের অন্যতম কার্যক্রমের একটি। কাপাসহাটিয়ায় নিজ গ্রামে এবং দূরবর্তী হাজরাবাড়ী এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে শিক্ষাকেন্দ্র খোলেন তাঁরা। নারীমুক্তি ও নারী জাগরণের লক্ষ্যে রাজিয়া সেই সময়ে হাজীপুরে গড়ে তোলেন নারী প্রগতি সাহিত্য সমিতি।
‘৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকেই শুরু হয় হাজীপুরের গান্ধী আশ্রমের ওপর একের পর এক হামলা ও আক্রমণ। এর আগে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা নাসির সরকারের ওপর নির্মম হামলা চালিয়ে তাঁর বুকের পাঁজরের বেশ ক’টি হাড় ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং মৃত মনে করে মালঞ্চ এলাকার এক জঙ্গলে ফেলে রাখা হয় তাঁকে। ‘৪৮ সালে ফের কয়েকটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে গান্ধী আশ্রমে। মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত লাগাতার এই হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটে গুঁড়িয়ে যায় জামালপুর গান্ধী আশ্রমের বিভিন্ন অবকাঠামো। শুধু টিকে থাকে কাপাসহাটিয়ায় আশ্রমের অফিস ঘরটি। কিন্তু, আশ্রমের বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেলেও এলাকার মানুষজনের স্মৃতিতে আশ্রমের শুভ ও কল্যাণী নানান উদ্যোগ ছিল সজীব ও জাগরূক। পিতা নাসির সরকার এবং অনুজ ভাই মোয়াজ্জেমসহ আশ্রমের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও শিক্ষার্থীরা মহৎ ও শুভদায়ী বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জাগিয়ে রাখেন আশ্রমের স্মৃতি।
সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের কূটচালে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পঞ্চাশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা প্রতিরোধে বৃহত্তর জামালপুর অঞ্চলে সাহসী ভূমিকা রাখেন নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন-এর পরিবার।
ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘৪৭-এর দেশভাগ তাঁর হৃদয়ে সৃষ্টি করেছিল গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত নিরাময়ে স্বদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যময় সমাজ বিনির্মাণের ব্রত নিয়েছিলেন তিনি, পিতা ও অনুজ ভাই-এর হাত ধরে। উদার, মানবিক, সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির যে জীবন সাধনা বাঙালি করে চলেছে হাজার বছর ধরে, সেই জীবনচর্যায় ছিল এই পরিবারটির প্রগাঢ় আস্থা। সে আস্থায় ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো।
সেই আস্থা ও বিশ্বাস থেকেই রাজিয়া খাতুন যুক্ত হয়েছিলেন ‘৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গণধিকৃত মুসলিম লীগের সার্বিক পরাজয় নিশ্চিত করতে পিতার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন জামালপুর-শেরপুরের পুরো এলাকা, অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে। পাকিস্তানী কালপর্বে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন সর্ব সময়। বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ যুক্ত থেকেছেন অগ্রণী এক নারীনেত্রীরূপে। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে অনুজ ভাই মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে যোগ দেন তাতে।
ষাটের দশকে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্রমাগত প্রতারণা ও বঞ্চনার মুখে বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই যখন মোড় নিচ্ছিল নতুন এক পথে, ইতিহাসের বাঁক ফেরার সেই সময়ে নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন অবস্থান নেন ময়মনসিংহ শহরে। নারীমুক্তি ও নারী জাগরণের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের পাশাপাশি সক্রিয় থাকেন বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ। ১৯৭০-এ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গঠিত হলে তিনি কাজ করেন ময়মনসিংহে, এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়ে। সংগঠনের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভানেত্রীরূপে দীর্ঘকাল নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ধর্মীয় গোঁড়ামী ও রক্ষনশীলতার অচলায়তন ভেঙ্গে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে নারীমুক্তি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ময়মনসিংহ শহরে হতদরিদ্র হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষজনের মাঝে শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কাজের সূচনা করেন রাজিয়া খাতুন।
‘৭১-এ তিনি ছিলেন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, রসদ যোগানোর বিবিধ কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন তিনি।
স্বদেশের হিতব্রতে সদা উদ্যোগী ও সক্রিয় এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত মানবমুক্তির সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর পরবর্তী জীবন উৎসর্গ করেছেন মানবমুক্তির সংগ্রামে। এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে নিয়োজিত করেছেন তাঁর সবকিছু। দীর্ঘ প্রায় আট দশকের ঘটনাবহুল কর্মপ্রবাহে তাঁর জীবন-সাধনার সেই বর্ণাঢ্য পরিচয়ই প্রতিভাত হয়।
স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় দীক্ষিত পরিবারে বড়ো হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভাবাদর্শের একজন মানুষ। দেশব্রতী পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন অমিত সাহস, আর দৃঢ় মনোবল। সে কারণে শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম-করে স্বদেশ-কল্যাণের কাজে এগিয়ে যেতে পারতেন তিনি। স্বদেশের নানান রাজনৈতিক বিপর্যয় কখনই তাঁর বিশ্বাস ও অঙ্গীকারে চিড় ধরাতে পারেনি। কি রাজনৈতিক জীবন, কি ব্যক্তি জীবন সুবিধাবাদ কখনই ঠাঁই পায়নি তাঁর জীবনে। দৃঢ়চিত্ত রাজিয়া খাতুন ছোটবড়ো সবাইকে সহজ আন্তরিকতায় টেনে নিতে পারতেন তাঁর কাছে, উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। সর্বমহলে ‘খালা আম্মা’ রূপে পরিচিত রাজিয়া খাতুনের সহজ সরল জীবন যাপনের মধ্যেও তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের দৃঢ়তা প্রকাশ পেতো। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম, নারী অধিকার ও নারীমুক্তি আন্দোলন, সামাজিক অনাচাররোধে নানান সামাজিক আন্দোলন সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অগ্রণী এবং উদ্যোগী, তরুণদের প্রেরণার উৎস। একান্ত বার্ধক্যেও তিনি থাকতেন মিছিলের অগ্রভাগে।
বৃটিশ শাসনামল থেকেই কাপাসহাটিয়ায় রাজিয়া খাতুনদের বাড়ীটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট ও বিপর্যয়ে তাঁরা ছিলেন বিপন্নজনের পরম সহায়। সর্বমহলে শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার কারণে তাঁদের বাড়ীটি হয়ে দাঁড়ায় নানা দল-মত-সংগঠনের নেতাকর্মীদের এক মিলনস্থল। এমনকি, যারা তাঁদের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাসের বিরোধী, তাদের কাছেও তাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। সবমিলিয়ে নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন অনন্যা এক নারী। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি ভালোবাসায়, বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকায় তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ এক মানুষ, অমিত সাহসী এক নারীনেত্রী।
২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নিজ গৃহে বিরলপ্রজ এই নারীনেত্রীর জীবনাবসান ঘটে। মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের হৃদয়ে সর্বক্ষণ অনির্বাণ ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আলোকশিখা। হৃদয়ের সেই আলোয় অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে নিরন্তর পথ হেঁটেছেন তিনি দীর্ঘ ৮০ টি বছর।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার অভিযাত্রী রাজিয়া খাতুনকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
উৎপল কান্তি ধর : পরিচালক, মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর
বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের যারা অংশভাক্, সমগ্র জীবন যারা উৎসর্গ করেছেন স্বদেশের মুক্তি, কল্যাণ ও হিতব্রতে, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যাপৃত থেকেছেন জীবনভর - মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন তাঁদেরই অন্যতম। নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যে সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের এক সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণই ছিল নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই মহৎ লক্ষ্যেই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে।
নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন ব্যতিক্রমী এক মানুষ। চিরাচরিত সংসার ও গার্হস্থ্য জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে নিজেকে যিনি বিলিয়ে দিয়েছেন স্বদেশের মুক্তি, কল্যাণ ও হিতব্রতে। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে উঠে মনুষ্যত্বের মানবিক সাধনায় জীবনভর ব্যাপৃত করেছেন নিজেকে। স্বদেশের জন্যে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমৃদ্ধ এক ভবিষ্যৎ রচনার স্বপ্নে, সকল মানুষের জন্যে সমঅধিকার, সমমর্যাদার এক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন সাচ্চা ও খাঁটি এক মানুষ, সমকালে যা একান্ত বিরল।
মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের জন্ম জামালপুর সদর উপজেলার পাঁচগাছি গ্রামে, তাঁর মাতুলালয়ে, ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১০ জ্যৈষ্ঠে। গান্ধীবাদী পিতার কাছ থেকে একান্ত কৈশোরে স্বদেশ চেতনার যে বীজমন্ত্রে তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন, ২০০৭ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর মুক্তি সাধনার সেই হিতব্রত থেকে বিচ্যূত হননি কখনো। নানা নিপীড়ন ও প্রতিকূলতা তাঁর সংকল্প ও বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া অসামান্য চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য ও দৃঢ়তার গুণে স্বদেশ-সাধনার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। তাঁর পিতৃনিবাস জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া গ্রামে। স্বর্ণ প্রসবিনী মাতা আছিরন বিবি। রাজিয়া ছিলেন চিরকুমারী।
নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন তাঁর পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পাঁচ ভাই-বোনদের মাঝে তিনি ছিলেন বড়। তাঁর অনুজ ভাই মোয়াজ্জেম হোসেনও ছিলেন স্বদেশব্রতের সাধনায় নিরলস এক কর্মী, গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জামালপুর মহকুমা কৃষক সমিতির দীর্ঘকালীন সভাপতি। ১৯৯৬ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। বোনদের মধ্যে জীবননেসা ও গুলবদনও বেঁচে নেই। পাঁচ ভাইবোনের স্মৃতি বহন করে কেবল বেঁচে আছেন বোন জাহানারা।
সেকালে, প্রতিকূল রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি রাজিয়া। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। কিন্তু, স্বদেশী আন্দোলনে উৎসর্গিতপ্রাণ কংগ্রেসী পিতার প্রেরণায় নিজ গৃহেই চালিয়ে যান নিরন্তর পড়াশোনার পালা। সত্যিকার অর্থেই স্বশিক্ষিত, প্রগতিশীল ও আধুনিকমনস্ক ছিলেন তিনি। তাঁদের পারিবারিক পাঠাগারটি ছিল সমৃদ্ধ ও বিশাল।
পিতার প্রেরণায় ও আগ্রহে মাত্র ১২ বছর বয়সেই জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেন রাজিয়া। পিতার হাত ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। দেশে ইংরেজ শাসন অবসানের লক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেতেন পিতার সঙ্গে, একান্ত কৈশোরেই। সে কারণে, রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে নাস্তিক অপবাদসহ নানা হুমকি সইতে হয় তাঁকে। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরূপে দেশের বিভিন্নস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সাইকেল চালিয়েও তিনি বহু সভায় যোগ দিয়েছেন। সে সময়ে তা ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের অন্যতম যুগ্মসম্পাদকরূপে সে সময়ে জামালপুর অঞ্চলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরার রায়পুরে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন রাজিয়া, তাঁর পিতার সঙ্গে। এই অধিবেশনে জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুসহ বহু বিশিষ্ট নেতাকে কাছ থেকে দেখা এবং তাঁদের কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জামালপুর শহরে এলে তাঁর সঙ্গে সাগ্রহে দেখা করে দেশে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে তাঁর কাছ থেকে দিকনিদের্শনা চান রাজিয়া। স্বকীয় যোগ্যতার গুণে মাত্র ১৪ বছর বয়েসেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পরাধীন ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমোচনে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বৈপ্লবিক পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনে বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’ প্রভাব ফেলে তাঁর ওপর, তাঁর পিতার মতোই। পিতা নাসির সরকারও ছিলেন ‘যুগান্তর’ অনুসারী।
বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমোচন এবং উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পথরেখা ধরে ১৯৩৪ সালে গড়ে ওঠে গান্ধী আশ্রম - জামালপুরের হাজীপুর বাজারে, ঝিনাই নদীর তীরে। উদ্যোক্তা রাজিয়ার দেশব্রতী পিতা নাসির সরকারসহ স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহৎপ্রাণ কিছু মানুষ। রাজিয়া খাতুন ছিলেন আশ্রমের অন্যতম পরিচালক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামালপুর অঞ্চলের মানুষকে পরাধীনতার গ্লানি মোচনের অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে হাজীপুরের এই গান্ধী আশ্রম। সেই সঙ্গে স্বদেশের কল্যাণসাধনায় নানান শুভ কর্মপ্রচেষ্টা শুরু হয় গান্ধী আশ্রমে। দেশজুড়ে পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশের হিতব্রতের মন্ত্রে উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত মানুষের এক কেন্দ্র হয়ে ওঠে গান্ধী আশ্রম। গান্ধী আশ্রমের বিবিধ কার্যক্রমের মধ্যে ছিল - চরকা কাটা, খাদি কাপড় বোনা, হস্তশিল্পজাত নানান সামগ্রী তৈরি, ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কাজকর্ম, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা, পাঠাগার ও শরীরচর্চা। সর্বোপরি ছিল স্বদেশপ্রেমের দীক্ষা। সে সময়ে গান্ধী আশ্রমে হিন্দু-মুসলিম ছাত্রী ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাদেরই একজন চিকিৎসক হালিমা খাতুন। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় এক চিকিৎসক। তিনি বলেন, আমি গান্ধী আশ্রমেরই সৃষ্টি।
পিতা নাসির সরকার এবং কন্যা রাজিয়া ছিলেন গান্ধী আশ্রমের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যমণি। গান্ধী আশ্রমের বিবিধ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন রাজিয়া এবং তাঁর কর্মীদল। মা ও প্রসূতি সেবা দেওয়া ছিল তাঁদের অন্যতম কার্যক্রমের একটি। কাপাসহাটিয়ায় নিজ গ্রামে এবং দূরবর্তী হাজরাবাড়ী এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে শিক্ষাকেন্দ্র খোলেন তাঁরা। নারীমুক্তি ও নারী জাগরণের লক্ষ্যে রাজিয়া সেই সময়ে হাজীপুরে গড়ে তোলেন নারী প্রগতি সাহিত্য সমিতি।
‘৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকেই শুরু হয় হাজীপুরের গান্ধী আশ্রমের ওপর একের পর এক হামলা ও আক্রমণ। এর আগে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা নাসির সরকারের ওপর নির্মম হামলা চালিয়ে তাঁর বুকের পাঁজরের বেশ ক’টি হাড় ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং মৃত মনে করে মালঞ্চ এলাকার এক জঙ্গলে ফেলে রাখা হয় তাঁকে। ‘৪৮ সালে ফের কয়েকটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে গান্ধী আশ্রমে। মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত লাগাতার এই হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটে গুঁড়িয়ে যায় জামালপুর গান্ধী আশ্রমের বিভিন্ন অবকাঠামো। শুধু টিকে থাকে কাপাসহাটিয়ায় আশ্রমের অফিস ঘরটি। কিন্তু, আশ্রমের বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেলেও এলাকার মানুষজনের স্মৃতিতে আশ্রমের শুভ ও কল্যাণী নানান উদ্যোগ ছিল সজীব ও জাগরূক। পিতা নাসির সরকার এবং অনুজ ভাই মোয়াজ্জেমসহ আশ্রমের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও শিক্ষার্থীরা মহৎ ও শুভদায়ী বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জাগিয়ে রাখেন আশ্রমের স্মৃতি।
সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের কূটচালে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পঞ্চাশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা প্রতিরোধে বৃহত্তর জামালপুর অঞ্চলে সাহসী ভূমিকা রাখেন নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন-এর পরিবার।
ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘৪৭-এর দেশভাগ তাঁর হৃদয়ে সৃষ্টি করেছিল গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত নিরাময়ে স্বদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যময় সমাজ বিনির্মাণের ব্রত নিয়েছিলেন তিনি, পিতা ও অনুজ ভাই-এর হাত ধরে। উদার, মানবিক, সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির যে জীবন সাধনা বাঙালি করে চলেছে হাজার বছর ধরে, সেই জীবনচর্যায় ছিল এই পরিবারটির প্রগাঢ় আস্থা। সে আস্থায় ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো।
সেই আস্থা ও বিশ্বাস থেকেই রাজিয়া খাতুন যুক্ত হয়েছিলেন ‘৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গণধিকৃত মুসলিম লীগের সার্বিক পরাজয় নিশ্চিত করতে পিতার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন জামালপুর-শেরপুরের পুরো এলাকা, অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে। পাকিস্তানী কালপর্বে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন সর্ব সময়। বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ যুক্ত থেকেছেন অগ্রণী এক নারীনেত্রীরূপে। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে অনুজ ভাই মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে যোগ দেন তাতে।
ষাটের দশকে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্রমাগত প্রতারণা ও বঞ্চনার মুখে বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই যখন মোড় নিচ্ছিল নতুন এক পথে, ইতিহাসের বাঁক ফেরার সেই সময়ে নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন অবস্থান নেন ময়মনসিংহ শহরে। নারীমুক্তি ও নারী জাগরণের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের পাশাপাশি সক্রিয় থাকেন বাঙালির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ। ১৯৭০-এ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গঠিত হলে তিনি কাজ করেন ময়মনসিংহে, এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়ে। সংগঠনের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভানেত্রীরূপে দীর্ঘকাল নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ধর্মীয় গোঁড়ামী ও রক্ষনশীলতার অচলায়তন ভেঙ্গে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে নারীমুক্তি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ময়মনসিংহ শহরে হতদরিদ্র হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষজনের মাঝে শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কাজের সূচনা করেন রাজিয়া খাতুন।
‘৭১-এ তিনি ছিলেন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, রসদ যোগানোর বিবিধ কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন তিনি।
স্বদেশের হিতব্রতে সদা উদ্যোগী ও সক্রিয় এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত মানবমুক্তির সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর পরবর্তী জীবন উৎসর্গ করেছেন মানবমুক্তির সংগ্রামে। এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে নিয়োজিত করেছেন তাঁর সবকিছু। দীর্ঘ প্রায় আট দশকের ঘটনাবহুল কর্মপ্রবাহে তাঁর জীবন-সাধনার সেই বর্ণাঢ্য পরিচয়ই প্রতিভাত হয়।
স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় দীক্ষিত পরিবারে বড়ো হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভাবাদর্শের একজন মানুষ। দেশব্রতী পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন অমিত সাহস, আর দৃঢ় মনোবল। সে কারণে শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম-করে স্বদেশ-কল্যাণের কাজে এগিয়ে যেতে পারতেন তিনি। স্বদেশের নানান রাজনৈতিক বিপর্যয় কখনই তাঁর বিশ্বাস ও অঙ্গীকারে চিড় ধরাতে পারেনি। কি রাজনৈতিক জীবন, কি ব্যক্তি জীবন সুবিধাবাদ কখনই ঠাঁই পায়নি তাঁর জীবনে। দৃঢ়চিত্ত রাজিয়া খাতুন ছোটবড়ো সবাইকে সহজ আন্তরিকতায় টেনে নিতে পারতেন তাঁর কাছে, উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। সর্বমহলে ‘খালা আম্মা’ রূপে পরিচিত রাজিয়া খাতুনের সহজ সরল জীবন যাপনের মধ্যেও তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের দৃঢ়তা প্রকাশ পেতো। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম, নারী অধিকার ও নারীমুক্তি আন্দোলন, সামাজিক অনাচাররোধে নানান সামাজিক আন্দোলন সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অগ্রণী এবং উদ্যোগী, তরুণদের প্রেরণার উৎস। একান্ত বার্ধক্যেও তিনি থাকতেন মিছিলের অগ্রভাগে।
বৃটিশ শাসনামল থেকেই কাপাসহাটিয়ায় রাজিয়া খাতুনদের বাড়ীটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট ও বিপর্যয়ে তাঁরা ছিলেন বিপন্নজনের পরম সহায়। সর্বমহলে শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার কারণে তাঁদের বাড়ীটি হয়ে দাঁড়ায় নানা দল-মত-সংগঠনের নেতাকর্মীদের এক মিলনস্থল। এমনকি, যারা তাঁদের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাসের বিরোধী, তাদের কাছেও তাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। সবমিলিয়ে নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুন ছিলেন অনন্যা এক নারী। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি ভালোবাসায়, বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকায় তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ এক মানুষ, অমিত সাহসী এক নারীনেত্রী।
২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নিজ গৃহে বিরলপ্রজ এই নারীনেত্রীর জীবনাবসান ঘটে। মহীয়সী নারীনেত্রী রাজিয়া খাতুনের হৃদয়ে সর্বক্ষণ অনির্বাণ ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আলোকশিখা। হৃদয়ের সেই আলোয় অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে নিরন্তর পথ হেঁটেছেন তিনি দীর্ঘ ৮০ টি বছর।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার অভিযাত্রী রাজিয়া খাতুনকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
উৎপল কান্তি ধর : পরিচালক, মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন!