ব্রহ্মপুত্র পাড়ে নতুন রাস্তায় গত শুক্রবার ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে গেলাম। বহুদিন পর। শেষ মনে হয় মার্চে গিয়েছিলাম দুদিন। তখনও কমলা বাতি ছিল।
আমি গেলাম বাংলারচিঠিডটকম থেকে ফেরার পথে। জুট মিলের সামনে একটি স-মিল আছে। তার পাশে একটি গলি রাস্তা। নতুন রাস্তায় উঠতে সেখান দিয়ে অতি সাবধানে পা ফেললাম। কিন্তু লাভ হয়নি। ডান পাটা কাদায় পড়েই গেল। অন্ধকার ও বহুদিন আসাযাওয়া নেই। তাই বুঝতে পারিনি।
রাস্তার পাশে অনেকেই দোকান খুলেছে। বেশ জমেই উঠে মনে হয়। এখন রাত, তাই ভীড় ছেলে বুড়োদের। তারাই হই হুল্লুর করছে। টিভি দেখার ব্যবস্থা আছে সব দোকানেই। টিভিও দেখছে বেশিরভাগ।
হাঁটাপথ দিয়ে হেঁটে যাই। ব্রহ্মপুত্র সেতুর দিকে। দাঁড়িয়ে একবার উল্টো দিকে তাকাই। বাতির সারিগুলো বেশ লাগে। নদে পানি বেশি। কয়েকটা নৌকা থেকেও মানুষের কথা কিছু ভেসে আসে কানে। ও পাড়ের বাড়ি ও গাছগুলোও অদ্ভূত এক আবহ তৈরি করে।
সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে প্রায়। এখন নেই। পশ্চিমের আকাশে হালকা মেঘের আড়ালে চাঁদকে দেখাচ্ছে ভূতের মত। রাস্তার ভেঙে যাওয়া অংশ ভরাট করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় ডেবে গেছে। উচা নিচু বুঝা যায়। সেখানে পানি জমে আছে। হাঁটাপথের সাথে রাস্তায় কিছু কিছু অংশে পানি জমে আছে।
সবচে’ আঁতকে উঠার বিষয় নজরে আসলো। ছেলেদের গ্রুপ। একদল হাঁটাপথের পাশে দাঁড়িয়ে-বসে সিগারেট ফুঁকছে। আঁড়চোখে তাকিয়ে কান খাড়া করলাম। নদের পাড়ে জঙ্গলের মত হয়ে আছে। সেখানেও দলের কেউ কেউ আছে। কথার কয়েকটা শব্দ বুঝা গেল। বাতাস উল্টা দিকে ছিল। অন্য কিছুর নেশা করলেই তো চিন্তার বিষয়।
এর মধ্যে একটা দল, ১০-১২ জন হবেই। সামনের সবার হাতেই মোবাইল। এসে আমার উল্টোদিকে চলে গেল। পিছনের দিকে থাকা একটা ছেলে অনেকটা উচু স্বরেই বলে ফেললো,‘বালের গ্রুপ খুলছে...’। সম্ভবত ফেসবুক গ্রুপের কথাই বলেছে।
যাই হোক, একদলকে দেখলাম মোবাইলে আইপিএল দেখছে। বাজিও ধরে মনে হলো।
ইউটিউব দেখা দলও আছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে এলো, ‘ভালো লাগলে লাইক দিন, আরও ভিডিও... সাবস্ক্রাইব করুন।’
আড্ডা দেওয়া গ্রুপও আছে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে গ্যাং কালচার আছে কিনা কে জানে। প্রায় কারোরই মুখে মাস্ক নেই। এরা আশপাশের এলাকারই হবে।
এরইমধ্যে একটা লোক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমার পেছন থেকে সামনে গেল। মাস্ক পড়া তবুও নিকোটিনের গন্ধ পেলাম। লোকটাকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে আমি কিছুক্ষণ দাড়ালাম। উত্তর দিকে তাকালাম। খানিক যাওয়ার পর ফেলে দিল দেখলাম। তারপর আবার নিশ্চিন্তে হাঁটা শুরু করলাম।
এবার একটি সম্পূর্ণ নতুন জিনিস দেখলাম। সেতুতে ল্যাম্পপোস্ট লাগিয়েছে। কয়েকমাস ফেসবুকে কয়েকটা ছবিতে দেখেছি। আজ নিজ চোখে দেখলাম। অন্ধকার দূরের সাথে দৃষ্টিনন্দনও বটে।
ব্রহ্মপুত্রে পানি বেড়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো পানিতে পড়েছে। রূপালি ঝিলমিল ঢেউ অনেক দূর থেকেই বুঝা যাচ্ছে। ভালোয় লাগলো সব মিলিয়ে।
তবে নাটকীয় ঘটনা ঘটলো যখন সেতুর নিচে গেলাম। বাতি নিভে গেল। হাহা। আসলে লোডশেডিং। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই সিএনজিচালকদের ডাকাডাকি। কই যাবেন, শেরপুর বলে একজন, আরেকজন বকশীগঞ্জ।
আমি মাথা নেড়ে না বলে সেতুর দিকে চলে যাই। অন্ধকার। গাড়ি এখন কম আসা যাওয়া করছে। আলো কম হলেও নদের পানি দেখা যাচ্ছে। তারমানে এদিকে লোডশেডিং। ওদিকে কমলা বাতিগুলো দেখা যাচ্ছে।
আমি হাঁটতে হাঁটতে সাতপাকিয়া বাজারে চলে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে জামালপুর থেকে শেরপুর আরকি। হাহা। এটা আসলে সীমান্তবর্তী জায়গা। বাজারের মাঝ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসা শুরু করলাম। বৃষ্টি আবার নামতে পারে বলে মনে হলো।
সেতুতে উঠে কয়েকপা এগোতেই হঠাৎ সব বাতি জ্বলে উঠলো। চমকে উঠেছি। মুখ দিয়ে তবুও ‘ওয়াও’ বের হলো। বেশ লাগলো। অনেক দূর পর্যন্ত কালো পানি বুঝা যায়।
সেতুর মাঝখানে যাওয়ার পর বুঝলাম কিছু বৃষ্টির ফোটা। ক্যাপ খুলে বুঝার চেষ্টা করলাম। তেমন নেই। বাতাসে আদ্রতা বেশি। তবুও আরও দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। অন্তত কোনো দাড়ানোর জায়গার কাছে গিয়ে বৃষ্টি শুরু হলে ভালো হতো ভাবলাম।
সেতুর সংযোগ রাস্তাটি আবার নতুন করে করেছে। আরও প্রশস্ত। দুপাশের গাছগুলোও বড় হয়েছে আরও। এদিকে ল্যাম্পপোস্ট নেই। জমাট বাঁধা অন্ধকার। বুক ধুরু ধুরু করছে। গাড়ি অনেক পর পর আসছে।
সেতুলি বেম্বো গার্ডেন পার হওয়ার পর বৃষ্টি শুরু হলো। এগোতে চেয়েও আবার পিছিয়ে এলাম। দৌড়ে গিয়ে একটি দোকানের সামনে দাড়ালাম। দোকান বন্ধ। তবে বারান্দার মত অনেক খোলা জায়গা। কয়টা বাজে এখন জানি না। মোবাইল ও ঘড়ি সাথে নেই। দশটার কাছাকাছি হবে। বৃষ্টি কখন থামে ভাবছি আর পাইচারি করছি। তখন দুইজন চাচা এসে দাঁড়ালেন। একজন মধ্যবয়সী, হাতে পলা। আরেকজনের বয়স বেশিই একটু মনে হলো। তিনি আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। বললাম। পলা হাতে চাচাকে তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, এদিকে হাঁটতে এসেছি, বৃষ্টি ধরলো।
পলা হচ্ছে মাছ ধরার একটি সরঞ্জাম। খাঁচার মত একটু লম্বা। উপরে ফাঁকা। পলা পানিতে ফেলে উপরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরা হয়।
ওই চাচা আসলে ইজিবাইকচালক। একবেলা চালিয়ে সন্ধ্যার পর মাছ ধরছে বের হয়েছেন। বাসা ডাকপাড়ার এদিকেই। হাতে রিচার্জ করা যায় একটি টর্চ। পলিথিন ব্যাগে কয়েকটি মাছ। একটু পর পর এদিক ওদিকে আলো ধরছিলেন। আর তখন বৃষ্টি দেখা যাচ্ছিল। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। কখন যে থামে তাই বলাবলি করলাম দুজনে।
বৃষ্টির পানিতে পুকুর জলাশয় ভরে মাছ ক্ষেতে চলে যায়। মূলত সেই মাছই ধরতে বের হয়েছেন তিনি। পানি নাকি অনেক। পলা একদম ডুবে যায়। একহাতে টর্চ নিয়ে আরেকহাতে মাছ ধরা কষ্টকরই হয়ে যায় জানালেন তিনি। অনেক মাছই নাকি উপর দিয়ে চলে গেছে। ধরতে পারেন নি।
চাচার সাথে অনেক ধরনেরই আলাপ হলো। ইজিবাইক থেকে শুরু করে মাছ ধরা, রাজনীতি, নির্বাচন ইত্যাদি। গাড়ির আলোতে একসময় বুঝা গেল বৃষ্টি কমে এসেছে। ঝিরিঝিরি।
আমি বললাম, চলেন আগাই, বৃষ্টি তো কমছে। তিনিও চলেন বললেন। দুজনে রাস্তায় নেমে একটু এগোতেই বৃষ্টি একেবারেই নেই হলো।
হাঁটতে হাঁটতে আরও কিছু আলাপ হলো। সব তো আর লেখা যায় না। খানিক দূরে গিয়ে এক পুকুরের পাশে ক্ষেতে নেমে গেলেন তিনি। আমি তাকে সাবধানে থাইকেন বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। চাচাও অবশ্য মাস্ক পড়েনি, একটু দুঃখই লাগলো।
রেলক্রসিংয়ে এসে দুইদিকের রাস্তায় তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম কোন পথে যাবো। অনেক ভেবে বিশেষ করে পানি থাকতে পারে ও অন্ধকার ভেবে স্টেশনের রাস্তার দিকে গেলাম না। অন্য রাস্তায় পা বাড়ালাম। পাওয়ার প্ল্যান্টের সামনে বুক কাঁপলো। শব্দ কম হচ্ছে। বজ্রপাতের কথা ভেবে শরীরে শিহরণ হচ্ছে।
এলাকা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামনে আরও হবে মনে হচ্ছে। সব বাসার সামনেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রশ্বস্ত রাস্তা হচ্ছে। কয়েকদিন পর মনে হয় বড়বড় দালানেও ভরে যাবে।
যাই হোক, কাঁদা-পানি মাড়িয়ে আলো-অন্ধকার পেরিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। এসে দেখি সাড়ে দশটার মত বাজে।
অনেকদিন পর এদিন বিছানায় কাত হয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।#
অসাধারণ😍
ReplyDelete