মো. রেজাউল করিম রেজা ॥
ওয়াল্ট হুইটম্যান রস্টো তার বিখ্যাত ‘দ্য স্ট্যাজেজ অব ইকোনোমিক গ্রোথ : অ্যা নন-কমিউনিস্ট ইকোনোমিক ম্যানিফেস্টো’ গ্রন্থে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যায় পাঁচটি স্তরের একটি ইতিহাসভিত্তিক মডেল উপস্থাপন করেন। তার তত্ত্ব মতে একটি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি পাঁচটি স্তরের মাধ্যেমে পর্যায়ক্রমে সংগঠিত হয়। স্তরগুলো হলো, সনাতন বা গতানুগতিক সমাজ, উড্ডয়নের পূর্বাবস্থা, উড্ডয়নকাল, পূর্ণ বিকাশের পথে যাত্রা এবং জনগণের উচ্চ ভোগ কাল। বরাবরের মত আজও আমি আমাদের জামালপুর জেলার কোন একটা সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করব। আজ আলোচনা করব রস্টোর প্রদত্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর তত্ত্বের আলোকে জামালপুরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবস্থান ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে। তার আগে এই স্তর তত্ত্বের প্রতিটা স্তর সমাজের কোন কোন বিষয়কে ইঙ্গিত করে তা জেনে নেই।
প্রথম স্তর ‘গতানুগতিক সমাজ’। এই সমাজে বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ সমাজে উৎপাদন সীমিত থাকে, ব্যবহৃত প্রযুক্তি অনুন্নত, অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক, সামান্য কিছু শিল্প স্থাপিত হলেও উৎপাদনশীলতা কম, শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, নিরক্ষতার কারণে সমাজ ভোগনির্ভর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন, জীবনযাত্রার মান নিচু, অধিক জনসংখ্যা ইত্যাদি।
‘উড্ডয়নের পূর্বাবস্থা’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্বিতীয় স্তর। এ স্তর একটি পরিবর্তনশীল সমাজের জানান দেয়। যা অর্থনীতিকে স্বয়ংক্রিয় হওয়ার জন্য শক্তি অর্জনে সহায়তা করে। আবার এই শক্তি অর্জনে ভূমিকা পালন করে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, উৎপাদকের উৎপাদন উদ্বৃত্ত, বাইরের কাঁচামালের চাহিদা, ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার সৃষ্টির ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধীরে ধীরে প্রসার, প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
তৃতীয়ত ‘উড্ডয়ন’ স্তরে আছে নগরায়নের ব্যাপক বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার দ্রুত প্রসার, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন, টেক্সটাইলস এবং এপারেল শিল্পের উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, প্রাথমিক অর্থনৈতিক স্তরের গুণগত পরিবর্তন ইত্যাদি।
পরের স্তরে আছে ‘পূর্ণ বিকাশের পথে যাত্রা’। এই স্তরে নতুন নতুন শিল্প-কারখানার উদ্ভব ঘটে, আগের শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ ঘটে, যোগাযোগ অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন ঘটে, সামাজিক অবকাঠামো (যেমন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি) নির্মাণে বড় আকারের বিনিয়োগ করা হয়, মূলধননির্ভর উৎপাদনের বদলে সামাজিক চাহিদা নির্ভর উৎপাদন শুরু হয় ইত্যাদি।
চূড়ান্ত স্তরে আছে ‘জনগণের উচ্চ ভোগ কাল’। এ স্তরে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়-বাণিজ্য অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষের আয় ও জীবন-যাত্রার ব্যাপক মানোন্নয়ন ঘটে, উচ্চ ভোগ্য পণ্যের (দামি পোশাক, গাড়ি, ফ্লাট, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ইত্যাদি) চাহিদা ও ভোগ বৃদ্ধি পায়, মানুষের হাতে মৌলিক চাহিদা মিটানোর পরও অতিরিক্ত অর্থ থাকে, গ্রামের লোকেরা শহরে বসবাস শুরু করে ইত্যাদি।
আলোচিত পাঁচটি স্তরের কোন স্তরে আমাদের জামালপুরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবস্থান বলে আপনার মনে হচ্ছে? প্রথম, দ্বিতীয় নাকি পরবর্তী কোন স্তরে? সবগুলো স্তরের কিছু কিছু উপাদান মিলতে পারে কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে সেই স্তরেই হবে যে স্তরের অধিকাংশ উপাদান মিলবে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় আমরা সবেমাত্র দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কেন? কারণ প্রথম স্তরের কিছু ক্ষেত্রে আমরা এখনও সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। যেমন আপনি দেখুন আমাদের এলাকার মানুষের উৎপাদন ক্ষমতার এখনো পুরো সদ্ব্যব্যবহার করতে পারিনি। অনেক মানুষ আছে যাদের দৈনিক আয় এক ডলারের চেয়েও কম। একজনে আয় করে পাঁচ জনে খায়। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন রিকশা-ভ্যান, অটোতে চার্জার-মোটর লাগানো পর্যন্তই। আবার সেই চার্জার, মোটর, ব্যাটারি আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হয়। অথচ এগুলো স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন সম্ভব। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে দুই যুগ আগের প্রযুক্তি। জামালপুরের অর্থনীতি এখনও ব্যাপকহারে কৃষিনির্ভর। বড় মাপের শিল্প-কারখানা তিনটি, তার আবার দুটিই রাষ্ট্রীয়। ছোট ছোট শিল্প-কারখানা খুবই কম। শিক্ষায় আমরা মাশআল্লাহ সর্ব পিছনে। এখনও অনেক কুসংস্কার রয়েই গেছে। এই সবই হল গতানুগতিক সমাজ স্তরের বৈশিষ্ট্য।
তাহলে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ উড্ডয়নের পূর্বাবস্থায় কেমন করে যাচ্ছি? যাচ্ছি, কারণ এই স্তরের কিছু শক্তি বা উপাদান ইতোমধ্যে আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। যেমন আমরা আধুনিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হচ্ছি যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিনিয়ত ভাঙা গড়ার এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা আছে। সেচ ব্যবস্থায় কিছুটা আধুনিকায়ন হয়েছে। কৃষক তার নিজের ভোগের বাইরে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রয় করতে পারছে। গত কয়েক বছরে আমরা বেসরকারি ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছি। তবে সঞ্চয় কম তাই বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার কিছুটা হয়েছে কিন্তু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না। কর্মের জন্য এখনও আমরা বহির্মুখী।
তাহলে আমাদের করণীয় কি? দেখুন, বাংলাদেশের অনেক জেলা আছে যেগুলো ‘উড্ডয়নকাল’ স্তর শেষ করে ‘পূর্ণ বিকাশের পথে যাত্রা’ স্তরে ঢুকে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা যেখানে তিন নম্বর স্তর থেকে চার নম্বর স্তরে যাচ্ছে সেখানে আমরা মাত্র দুই নম্বর স্তরে ঢুকছি। অথচ নৌ, সড়ক, রেলপথ ও সীমান্ত সবই রয়েছে আমাদের। সঠিক পরিকল্পনায় যোগাযোগ মাধ্যমের এই সুযোগগুলোকে কাজে লাগালে এ জেলাটি দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। দারিদ্রের দুর্নাম ঘুচিয়ে হয়ে উঠতে পারে উন্নত এক জেলা। কেন পারছি না? এর পিছনে অন্যতম কারণ এখানে ভারি, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প-কারখানা গড়ে না ওঠা। যার কোনো বিকল্প আমাদের নেই। খেয়াল করে দেখুন আমাদের এলাকায় আছে বিপুল পরিমাণ শ্রম শক্তি। যার অধিকাংশ অন্য জেলায় সস্তা শ্রমে নিয়োজিত আছে। অথচ তারা এলাকায় থেকে একই কাজ অনেক কম পারিশ্রমিকেও করতে রাজি আছে। কেন আমাদের এলাকায় এ পর্যন্ত একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠেনি? দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টসে তো আমাদের এলাকার শ্রমিকেরাই নিয়োজিত। ভোলার মত চরাঞ্চলেও গড়ে ওঠেছে সিরামিকস থেকে শুরু করে নানা ধরণের ভারি শিল্প-কারখানা। অথচ সবদিক থেকে উপযুক্ত পরিবেশ থাকার পরও আমাদের জেলায় গড়ে ওঠেনি লোহা, পাট, সিমেন্ট, ফুড প্রসেসিং, প্লাস্টিক কিংবা সিরামিকসের মত ভারি শিল্প-কারখানা। আমাদের জেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের শিল্পকারখানা গড়ে তোলা সহজ। তার জন্য দরকার দেশি-বিদেশি দক্ষ ও বড় বিনিয়োগকারী। সেই সাথে বিনিয়োগকারীরা যাতে এখানে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হয় সেজন্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের জন্য মরুভূমির বুকে এক পাত্র জলের মত একটা খবর হল যে ইতিমধ্যে জেলায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন বা ইপিজেড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। এখানে ৪০০ একর জমির উপর শতাধিক ভারি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। আসা করি প্রকল্পটি দ্রুত আলোর মুখ দেখবে।
এত গেল বৃহৎ শিল্পের হাড়ির খবর। আমাদের জেলার শিল্পোন্নয়নে ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা কি করতে পারি? হ্যাঁ আমরাও পারি। অনেক ছোট ছোট কারখানা আছে যেগুলো একটু বুদ্ধি খাটিয়ে অল্প পুঁজিতে নানা ধরনের পণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে ছাড়াও বাইরে রপ্তানি করা যায়। তেমনি কিছু কারখানা হতে পারে এক দুই সারির গার্মেন্টস, জুতা ও স্যান্ডেল, খেলনা, সুতা, মোজা, গেঞ্জি, পাটের ব্যাগ ও পাপোশ তৈরি, মম, কলম, চিপস, বিস্কুট, জুস, সাবান, ডিটারজেন্ট, লিকুইড ওয়াশ সোপ ও বার, পঁচনশীল পণ্যের কোল্ড স্টোরেজ, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, বৈদ্যুতিক পাখা, সুইচ, হোল্ডার, বোর্ড ও ব্যাটারি তৈরি, কাচের জিনিসপত্র তৈরি, সিরামিকসের শো পিস ও ফুলদানি বানানো ছাড়াও জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য নকশি কাঁথাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন ব্যবস্থার উন্নোয়ন করে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি শিল্প স্থাপন করা যায়। এইসব ব্যবসায় করার জন্য অনেক বেশি পুঁজির দরকার হয় না। ছোট ছোট অনেক দেশি ও চায়নিজ মেশিন দিয়ে এগুলো সহজে ও স্বল্প খরচে তৈরি করা যায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য অঞ্চলে কিংবা বিদেশেও রপ্তানি করা যায়। মেশিনপত্র কোথা থেকে সংগ্রহ করা যায় এবং কিভাবে চালাতে হয় তা অন লাইন ঘেটে কিংবা ইউটিউব দেখে অনেক ভাল ধারণা পেতে পারেন। নিতে পারেন প্রশিক্ষণ। তা ছাড়াও ব্যবসায়িক ধারণা শেয়ার ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে অনেক ফেসবুক, ইউটিউব গোষ্ঠী বা দল ও পাতা আছে যেমনঃ প্রিপারিং ফর বিজনেজ, নট ফর বিসিএস, ই-ক্যাব, বিজনেস আইডিয়া জেনারেশন পার্ক, তথ্য আপা ইত্যাদি। যেখানে কি ব্যবসায় করবেন, কিভাবে করবেন, মূলধন কেমন লাগবে, কাঁচামাল কোথায় পাবেন প্রভৃতি সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা পাবেন।
সর্বশেষ কথা জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেই পর্যন্ত সম্ভব না, যে পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ পরিপূর্ণ না হবে। তাই আগে শিল্পপতি নয়, শিল্পের মালিক হন। হোক না তা ছোট কিংবা মাঝারি। জেগে উঠো জামালপুরবাসী।
লেখক : মো. রেজাউল করিম রেজা, একজন ব্যাংকার
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন!