‘আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নাই। আমার বাবা দোকান থেইকা চার্জার লাইট নিয়া আসলে পড়ি। পড়তে পড়তে চার্জার নিভা যায়। রাইতে পড়ালেখার খুবই সমস্যা হয়। সোলার প্যানেল পাইয়া ভালোই হইলো। রাইতে পড়ার আর সমস্যা হবো না। আগের চাইতে বেশি সময় পড়া যাবো। পড়ালেখা নিয়া আমার আত্মবিশ্বাস আরও বাড়লো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম জানাই। তারে ধন্যবাদ দিলাম। কথা দিলাম আমার পরীক্ষার ফল জীবনেও খারাপ হবো না।’ বলছিল মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা ইউনিয়নের হাজরাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নিজামুল।
মেলান্দহ উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে শনিবার দুপুরে সোলার প্যানেল নিতে এসেছিল সে। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এই দিন সরকারি বরাদ্দের ২৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২১৬ জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর হাতে একটি করে সোলার প্যানেল তুলে দেন। প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে সপ্তম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী অর্থাৎ ১, ২ ও ৩ রোল নম্বরধারী ছাত্র-ছাত্রীকে এ সহায়তার তালিকায় আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সোলার বিদ্যুৎ সহায়তায় আনা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানালেন। এ সহায়তার প্রতিটা সোলার প্যানেলের মূল্য ২০ হাজার ৮০০ টাকা। এই সোলার প্যানেলের সাথে একটি করে ফ্যানও রয়েছে। পড়তে বসে আলো পাবে। গরমের দিনে ফ্যানও চালাতে পারবে।
জানা গেল, নিজামুল দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তারা দুই ভাই দুই বোন। নিজামুল সবার বড়। একবোন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক বোন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তার কণিষ্ঠ ভাইটি শিশু। তাদের বাবা সাইদুর রহমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। হাজরাবাড়ী বাজারে তাদের একটি মনোহারী দোকান রয়েছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় বিশেষ করে রাতে তাদের পড়ালেখা করতে খুবই অসুবিধা হতো। আজকে সোলার প্যানেল পেয়ে নিজামুল তার খুশির কথাই বলছিল। অনুষ্ঠানে বিনামূল্যে সোলার প্যানেল নিতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সবার মুখেই নিজামুলের মতোই প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল।
মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের খাসিমারা পুটিয়াপাড়া গ্রামে এখনও সরকারের বিদ্যুৎ যায়নি। ওই গ্রামে তিনশ’র অধিক ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করে থাকে। স্থাপিত হয়েছে খাসিমারা পুটিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী মিতু পারভীন। তার রোল নম্বর ১। একই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আরিফা আক্তার। তার রোল নম্বর ২। মেধাবী ছাত্রীক্রম হিসেবে তারা দুই বোন দুটি সোলার প্যানেল পেয়েছে। তাদের বাবা রইছ উদ্দিন একজন কৃষক। মা লাইলী বেগম কিষানী। তারা তিন বোন এক ভাই। বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ভাই মাদরাসায় পড়ে। মিতু পারভীন বলছিল, ‘আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। সবারই একই সমস্যা। রাত্রে পড়তে খুব সমস্যা হয়। আবার দিনের বেলাও পড়ার সময় পাই না। এখন আর আমাদের বাড়িতে বাতির কোনো সমস্যা থাকলো না। আমরা পড়ালেখা করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের গ্রামের সব ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে সোলার বাতি দেন।’ ‘আমরা দুইটা সোলার পাইলাম। ঘর আর অন্ধকার থাকবো না। আমরা মেলা রাইত পর্যন্ত পড়বের পামু।’ বলছিল মিতু পারভীনের ছোটবোন আরিফা আক্তার।
মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা ইউনিয়নের ফুলকোচা আলেয়া আজম উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. মাহবুবুর রহমান। রোল নম্বর ১। তাদের বাড়িতেও বিদ্যুৎ নেই। মাহবুবুর রহমানের কাছ থেকেই জানা গেলো তাদের এলাকায় যাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে তারাও সমস্যায় আছেন। বিদ্যুৎ থেকেও যেন নেই। ‘আমাদের গ্রামে রাইতে বিদুৎ যায় আর আসে। ঝড়বৃষ্টির দিন টানা দুই-তিনদিন বিদ্যুৎ থাকে না। লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হয়। আজকে সোলার পাইলাম। আমার আর সমস্যা হইবো না। বেশি বেশি পড়তে পারমু। সবাইরেই সোলার বাতি দেওয়া দরকার।’ বলছিল মাহবুবুর রহমান।
দুরমুঠ ইউনিয়নের কলাবাধা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আমেনা আক্তারের বাবা আবু তাহের একজন কৃষক। তার রোল নম্বর ২। তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। আমেনারা তিন বোন এক ভাই। সেও একটি সোলার প্যানেল পেল। তাকে খুব খুশি খুশি লাগছিল। ‘আমি আগে কেরাসিন তেলের কুপিবাতি দিয়া পড়তাম। রাইতে বেশি হইলে এক ঘন্টা পড়তাম। সোলার বাতি লাগাইলে তিন-চাইর ঘন্টা পরবার পামু। একটা ফ্যানও দিছে। আরও ভালো হইছে।’ বলছিল আমেনা আক্তার। তার বাবা আবু তাহেরও সাথে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘এহন আর কুপিবাতির তেল কিনন লাগবো না। অরা যাতে ভালো মতো পড়ে তার খোঁজ রাখমু।’
নয়জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ফুলকোচা আলেয়া আজম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুনূর রশিদ এসেছিলেন সোলার প্যানেল বিতরণ অনুষ্ঠানে। তিনি বললেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের যারা আজ সোলার প্যানেল পেল তাদের অনেকের বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ নেই। যাদের আছে তারাও লোডশেডিংয়ের কারণে বিশেষ করে রাতে পড়ালেখা করতেই পারে না। আজকাল ছেলেমেয়েরা কুপিবাতি বা হারিকেনে পড়তে চায় না। সোলার প্যানেল দেওয়াতে তাদের দীর্ঘ দিনের সমস্যা দূর হলো। রাতে তারা এখন ঝকঝকে আলোতে পড়ালেখা করতে পারবে। সরকারের এটি ভালো উদ্যোগ।’
শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে সোলার প্যানেল তুলে দেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। ছবি : আলী আকবর |
বিনামূল্যে সোলার প্যানেল বিতরণের আগে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম যখন বক্তব্য রাখছিলেন শিক্ষার্থীরা তখন তার কথা খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম তাদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘এই যে আজকে তোমাদের বিনামূল্যে সোলার প্যানেল দেওয়া হলো। এর একেকটির মূল্য ২০ হাজার ৮০০ টাকা। এটা কিন্তু কম নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে যেমন নতুন বই উপহার দেন। বিদ্যুতের অভাবে তোমাদের যাতে লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। সেই জন্যই প্রধানমন্ত্রী তোমাদের এই সমস্যা দূর করে দিলেন। তোমরা ভালো করে লেখাপড়া করবে। তোমাদেরকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে সোলার প্যানেল তুলে দেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। ছবি : আলী আকবর |
তিনি আরও বলছিলেন, ‘আজকে এখানে দেখছি মেয়েরাই বেশি। তোমরাই বেশি সোলার প্যানেল নিয়ে যাচ্ছো। আজকে দেশে মেয়েরাই মেধাবী বেশি। নারীরা মেধা দিয়ে তাদের স্থান দখল করছে। দেশের ৪৬ জেলার মধ্যে ১৩ জন ডিসি নারী, এসপি রয়েছে ১৬ জন। সেনাবাহিনীতে একজন নারী ব্রিগেডিয়ার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী নারী। তার গাড়িও চালান একজন নারী। জাতীয় সংসদে ৫০ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য, ছয়-সাতজন মন্ত্রী নারী, বিচারক, পাইলট, প্যারাকমান্ডো অফিসার থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে নারীরা আজ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের ঘর থেকে বের করে এনে এই সুযোগ করে দিয়েছেন। তাই তোমরাও পারবা। কিন্তু ভালো মতো পড়ালেখা করতে হবে। পড়ালেখা ছাড়া, মেধাবী হওয়া ছাড়া তোমরা কোনো কিছুই করতে পারবা না।’
সোলার প্যানেল নিতে আসা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী নিজামুল, মিতু পারভীন, আরিফা আক্তার, মো. মাহবুবুর রহমান ও আমেনা আক্তারের মতো অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের খুশির কোনো কমতি দেখা যায়নি। তাদের আরও অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেল, গ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হয়। অনেকেরই রাতে কুপিবাতিতে পড়ার সামর্থ নেই। অনেকেই হারিকেন-কুপিবাতিতে পড়তে চায় না। তারা সব ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে সোলার প্যানেল স্থাপন করে আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছে।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন!