‘ইন্টারনেটের পত্রিকা বন্ধ করে দিতে হবে। তাইলে পত্রিকার পাঠক বাড়বো। নইলে সব পত্রিকা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবো। ইন্টারনেটে পত্রিকা ছাইড়া দেওয়ার কারণে পত্রিকার মাসিক গ্রাহক ধইরা রাখা মুশকিল হইতেছে। নানাভাবে মন গলায়া পত্রিকা দিতে হয়। বড় বড় অফিসারেরা পত্রিকা নিতে চান না। অনেকেই মোবাইল বাইর কইরা ইন্টারনেটের হুবহু পত্রিকা দেখায়। ইন্টারনেটের পত্রিকা বন্ধ কইরা দিয়ন যায় না?’ বলছিলেন জামালপুরের প্রবীণ সংবাদপত্র বিক্রেতা মো. জবেদ আলী। প্রায় ৩৫ বছর ধরে জামালপুর শহরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তার বর্তমানে বয়স ৬১ বছর।
সংবাদপত্র ব্যবসা কেমন চলছে। ইন্টারনেট অনলাইনে পত্রিকা প্রকাশ হওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- এসব বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপচারিতার সময় অনেক আক্ষেপের কথা তিনি শোনালেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে অনেক কষ্টে দারিদ্রতা কাটিয়ে উঠার স্মৃতিময় কাহিনিও শোনালেন তিনি। ইন্টারনেট সম্পর্কে তার ধারণা নেই বললেই চলে। স্মার্টফোনও কিনেন নাই। কিন্তু উনি শুনে থাকেন যে ইন্টারনেটে সবই দেখা যায়। বাসে পত্রিকা আসার আগেই ইন্টারনেটে সব পত্রিকা পড়া যায়। পাঠক আগের মতো পত্রিকা কিনতে আর আগ্রহ দেখায় না। এই বিষয়টি এখন তাকে সারাক্ষণ ভাবায়। তার আগে জেনে নেই তার এ পেশায় আসার গল্প। আর অনেক কষ্টে গুছিয়ে উঠা জীবনের স্মৃতিগুলো।
মো. জবেদ আলীর বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। জামালপুর বেলটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। জীবিকার তাগিদে এরপর তার আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৯ সালে বিয়ে করেন জামালপুর পৌরসভার বগাবাইদ এলাকায়। স্ত্রী মরিয়ম বেগম গৃহিণী। তাদের তিন ছেলে। পত্রিকা বিক্রির কষ্টের টাকা দিয়ে তিনি তিনছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। বড় ছেলে সুমন মিয়া স্নাতক পাস। চাকরি হয়নি। বাবার পত্রিকা ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীও উচ্চ শিক্ষিত, এমএ পাস। মেজো ছেলে রিপন মিয়া ডিপ্লোমা কৃষিবিদ। তারও চাকরি হয়নি। এখনও পড়ালেখা করছেন। কণিষ্ঠ ছেলে রাজিব মিয়া অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাস। তারও চাকরি হয়নি। তিনি আইন মহাবিদ্যালয়ে উকালতি পড়াশোনা করছেন।
জামালপুর প্রেসক্লাবে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় সংবাদপত্র এজেন্ট মো. জবেদ আলী। ছবি : আয়নাল হক কালাচান |
মো. জবেদ আলী জানালেন, বিয়ের পর কঠিন চাপে পড়েন। ১৯৮০ সালের দিকে হবে। বাড়ির সামান্য জমিজমায় সংসার চলে না। একদিন জানতে পারেন শহরের সকাল বাজার এলাকায় সংবাদপত্র এজেন্ট মজিবর রহমান পত্রিকা বিক্রি করার জন্য লোক নিবেন। আজকে যারা সংবাদপত্র বিক্রি ও সরবরাহের ব্যবসা করে সংসার গুছিয়েছেন তাদের সবারই ওস্তাদ ছিলেন এই মজিবর রহমান। তিনি বর্তমানে বেঁচে নেই। তারও দুই ছেলে এই শহরে প্রতিষ্ঠিত, কাগজ-খাতা কলম ও স্টেশনারি দ্রব্যের বড় ব্যবসায়ী তারা।
মো. জবেদ আলী বললেন, ‘মজিবর ভাইয়ের পত্রিকা ব্যবসায় চাকরি নিলাম। বেতন মাসে মাত্র ২০০ টাকা। তখন বারো পৃষ্ঠার সাদাকালো পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা, বাংলারবাণী, দৈনিক আজাদ এই পত্রিকাগুলার দাম ছিল ৫০ পয়সা করে। তার ওখানে দশ বছর চাকরি করি। ১৯৯০ সালে বাদ দিয়ে আবার বাড়ি চলে যাই। সংসার, আবাদে ব্যস্ত থাকি। এইভাবে চলে পনেরো মাস। কিন্তু সংসার চলে না। নিজেই পত্রিকা বিক্রির ব্যবসা করার চিন্তা করি। সাংবাদিক লেবু (শফিক জামান) ভাইয়ের কাছে যাইয়া বললাম আমাকে ভোরের কাগজ আইনা দেন। ব্যবসা শুরু করি। ১৩ কপি ভোরের কাগজ দিয়া শুরু করি। প্রতিদিন ১৩ টাকা লাভ হয়। প্রতিদিন বাড়তে থাকে। আমার লাইনও বাড়ে। এরপর দৈনিক জনতার এজেন্ট হই। ৭০ কপি দিয়ে শুরু করি।’ তার কাছ থেকেই জানা গেল, পরবর্তীতে ওই সময়ের বহুল প্রচারিত ও আলোচিত দৈনিক জনকণ্ঠের এজেন্ট হয়ে তার ব্যবসার সাফল্যের মোড় ঘুরে যায়।
মো. জবেদ আলী ধীরে ধীরে কষ্ট করে এই ব্যবসায় সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি নয়টি পত্রিকার এজেন্ট। ৫ হাজার ৪৫০ কপি পত্রিকা আসে তার নামে। এক সময় তিনি মাসে ২০০ টাকা বেতনে পত্রিকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। আজ তার বিটেই দু’জন কর্মচারী কাজ করে। সেই দুজনকে তিনি মাসে ৬ হাজার টাকা করে বেতন দেন। বর্তমানে তিনি এই ব্যবসা থেকে প্রতিমাসে কমিশন বাবদ আয় করেন ৩০ হাজার টাকা। জমিজমা, বাসাবাড়ি সবই করেছেন। ছেলেদের পড়ালেখা করিয়েছেন। সংসারের অভাব দূর করেছেন। এর সবই করেছেন পত্রিকা বিক্রির ব্যবসা থেকে। ৩৫ বছরের মধ্যে তিনি বড় ধরনের কোনো অসুখেও ভুগেননি। তবে কয়েকমাস ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীরটাও আগের মতো ভালো যাচ্ছে না। তবুও সকালে বেরিয়ে পড়েন পত্রিকার কাজে। কিন্তু ইন্টারনেট অনলাইনের এই ডিজিটাল সময়ে জবেদ আলীকে পত্রিকা ব্যবসা নিয়ে আবার ভাবিয়ে তুলছে। তিনি এ নিয়ে বেশ শঙ্কিত। রোদেপুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যে গ্রাহকের ঘরে ঘরে সংবাদপত্র পৌঁছে দিতেন। যে গ্রাহকদের এক সময় পরিবারের সদস্যদের মতো মনে করতেন। সেই রকম সম্পর্কের মানুষগুলো কেমন জানি ছাপা কাগজের সংবাদপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
‘আমার তেমন কোনো অসুখ হয়নি। ঝড়-বৃষ্টিতে ছাতা-পলিথিন দিয়া ঢাইকা পত্রিকা বাসায় বাসায় দিয়া আইছি। আমি ভিজলেও পত্রিকা ভিজবার দেই নাই। অনেক কষ্ট করছি। গ্রাহকেরা যেন আমাদের পরিবারের লোকদের মতোই। আগে সব পত্রিকা সাদা-কালো ছিল। তখন ট্রেনে পত্রিকা আসতো। মানুষ অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতো পত্রিকার জন্যে। তখন ইন্টারনেট ছিল না। ইদানিং গ্রাহকেরা দেরি হইলে পত্রিকা নিতে চান না। মোবাইল সেটের মধ্যেই পত্রিকা দেইখা ফালায়। বলে যে পেপার দিয়া কি হবো। বড় চাপের মধ্যে আছি। গ্রাহক ছাড়াও আমার বিটে আগে বাইরেও পত্রিকা বিক্রি হইতো। দিনে অন্তত ৩০০ টাকার পত্রিকা বেচতাম। এখন কিনতেই চায় না। পত্রিকার পাঠক আর বাড়বো না। কমতে শুরু করেছে।’ বলছিলেন জবেদ আলী।
তিনি আরও বললেন, ‘আমার এক সময় কঠিন জীবন গেছে। যেন টাকার সাথে যুদ্ধ করছি। তারপরও আমার আফসোস। আমার ছেলেদের পড়াইলাম। ডিগ্রি এমএ পাস করলো অরা। কিন্তু একটারেও চাকরি নিয়া দিতে পারলাম না। এখন আবার ইন্টারনেট আইসা পত্রিকা ব্যবসায় হুচট খাইতাছি। পত্রিকা মালিকরা ভুল করতাছে। উনারাও মরবো। আমগরেও মারবো। গ্রাহকেরা পত্রিকা না নিলে। না কিনলে আমরা কি করমু। বাঁচমু কেমনে?’
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন!