সমাজের এক মারাত্মক ব্যাধির নাম বাল্যবিয়ে। যার কোন সুফল দিক নেই। অসংখ্য অপরাধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখে বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য সারাজীবনের কান্না হয়ে আসে। বেঁচে থাকা জীবনের পরতে পরতে পিতা-মাতার ভুলের আগুনে জ্বলতে হয় বাল্যবিয়ের শিকার একজন মেয়েকে।
সম্প্রতি জামালপুরে বাল্যবিয়ের মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় চেতনাবোধ এবং মানবিক তাড়না থেকে এ লেখার উদ্ভব।
লেখার শুরুতেই পাঠক বন্ধুদের নিকট অতীতের কাছে নিয়ে যেতে চাই। জামালপুরে ২০১৪ সাল থেকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে যে জাগরণ তৈরি হয়েছিল গোটা দেশের জন্য তা ছিল দৃষ্টান্ত। তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খানের গতিশীল নেতৃত্বে জামালপুরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠে। ২০২০ সাল পর্যন্ত সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং সুফল ভোগ করে এ জনপদের মানুষ। মহামারী করোনাকাল অনেক কিছুর মতোই জামালপুরে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রমকে থমকে দেয়।
২০১১ সালের এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মধ্যে জামালপুর জেলা শীর্ষস্থান দখল করার মতো অগৌরব, লজ্জা ও দুঃখজনক চিত্র আমাদের সামনে চলে আসে। এ অবস্থা উত্তরণে আমরা অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে কাজ করার চেষ্টা করি। ১৯৩৫ সালে অর্থাৎ ৮৪ বছর আগে বৃটিশ সরকার প্রণীত বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন তখন পৃষ্ঠাবন্দি হয়ে থাকে। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় ছিল না। ২০১৩ সালে প্রথমআলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে জামালপুরসহ বাংলাদেশের বাল্যবিয়ের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলে সরকার কিছুটা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এগিয়ে আসে ইউনিসেফ। ২০১৩ সালের শেষের দিকে জেলা প্রশাসক হিসেবে জামালপুরে দায়িত্ব নেন শাহাবুদ্দিন খান। আমরা জামালপুরের এ অবস্থা থেকে মুক্তির উদ্যোগ নেয়ার জন্য আবেদন জানাই। তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের ডাক দেন। অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি উন্নয়ন সংঘ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে অন্তপ্রাণ নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ইউনিসেফ ও জেলা প্রশাসন উন্নয়ন সংঘকে আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়া শুরু করে। প্রবল গতি পায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন।
জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খানের নির্দেশনায় সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ পথে নেমে আসে। অভূতপূর্ব এক জাগরণ তৈরি হয় জামালপুরে। রাজনৈতিক নেতারাও তাদের কর্মসূচিতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বক্তব্য রাখেন। একটা ইস্যুতে একটি দরিদ্রপ্রবণ ও প্রশ্চাৎপদ জেলা জামালপুরে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথা বলা, আওয়াজ তোলা আমার দেখা প্রথম। এর সুদীর্ঘ বছর পর ২০২৪ সালে জুলাই থেকে আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হলো সরকার পতনের এক দাবিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার পথে নেমে আসা।
যাই হোক ২০১৪ সাল থেকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জামালপুরে নেয়া হয় বহুমাত্রিক কার্যক্রম। তন্মধ্যে উঠান বৈঠক, বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আলোচনা, ওয়ার্ড উন্নয়ন কমিটির বৈঠক, গ্রামে গ্রামে পথনাটক, বাউল সংগীতের আসর, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালা, স্টাডি ট্যুর, সিনেমা হলগুলোতে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন, স্থানীয় প্রত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রচার, লিফলেট, পোস্টার, বিলবোর্ড স্থাপন, বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ, বাল্যবিয়েকে ‘না বলুন’ শব্দ সংযুক্ত করে ব্যাংকের লেনদেন স্লিপে সিল মারা, বিভিন্ন পর্যায়ের রশিদ বই এ একই শব্দ লিখে সিল মারা, ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সমাবেশের আয়োজন করা এবং সেখানে জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য রাখা, ট্রেন, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গণপরিবহনে স্টিকার লাগানো, ইউনিয়ন ও উপজেলা স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোকে কার্যকর করা, প্রচলিত আইনের কার্যকর করা, নিকাহ নিবন্ধকদের (কাজি) ও ধর্মীয় নেতাদের কঠিনভাবে নির্দেশনা প্রদান করাসহ ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করে তাক লাগিয়ে দেওয়া হয় দেশবাসীকে। বিভিন্ন জেলা থেকে জামালপুরে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রম দেখতে শিক্ষা সফরে আসেন। সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং বিদেশী দাতাসংস্থার লোকজন চলে আসেন জামালপুরে।
সারাদেশের বিচারে বাল্যবিয়ে নিরোধে জামালপুর জেলা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার মতো গৌরব অর্জন করে। ৮১:৮২ হারের বাল্যবিয়েকে ৪০% নীচে নামিয়ে আনা হয়। জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খান শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত হন। আমার সৌভাগ্য হয় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আমাকেও পাঠান হোটেল শেরাটনে। সেই দিনটা যেমন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে তেমনই মনের মনিকোঠায় পরম প্রিয় শাহাবুদ্দিন স্যার এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছেন। জামালপুরবাসী তাঁকে কখনো ভুলবে না। তাঁর সাড়ে তিন বছরে দায়িত্বকালীন জামালপুরকে তিনি অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। এত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাঝেও তিনি ছিলেন দৃঢ় চেতনার মানুষ। এ জন্য তাকে নানা অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। বিএনপি জামাতের অনুসারী বলে সংবাদ ছাপা হয়েছে। এজন্য তাকে বিভাগীয় তদন্তের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আবার সরকারি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। সবচেয়ে তাঁর বড় প্রাপ্তি তিনি আপামর জামালপুরবাসীর অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছেন। জামালপুরের নকশিকাঁথা শিল্পকে তিনি ব্র্যান্ডিং করেছেন। অনেক কীর্তিগাথা আছে জামালপুরে শাহাবুদ্দিন স্যারের। তাঁকে নিয়ে অন্য সময় আরও বেশি করে লেখার ইচ্ছে আছে।
আজকে যারা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ধীর গতিতে কাজ করছেন তাদের কাছে আমার উদাত্ত আহ্বান ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উপরোল্লেখিত অংশ বিশেষ কাজগুলোর পাশাপাশি জামালপুর জেলা প্রশাসন এবং উন্নয়ন সংঘে সংরক্ষিত ছবি, ভিডিও, নিউজ ক্লিপ, কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন, কেসস্টাডিসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। জামালপুর বাল্যবিয়ে নিরোধ কার্যক্রমে একটি মডেল বা উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে আমার কিছু আরও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আছে। যেমন ১৮ বছরের নীচে বয়সী কোন ব্যক্তির হাতে এন্ড্রয়েট ফোন না দেওয়া। তথ্য, প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে শিশু, কিশোরদের রক্ষা করা, তাদের ধর্মীয় অনুশাসন এবং বই পড়ায় আগ্রহ করে তোলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে মনোযোগের সাথে অংশগ্রহণ করানো, সামাজিক, মানবিক এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কিত লেখা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, কিশোর-কিশোরীদের তালিকা তৈরি করা এবং প্রতিমাসে তালিকা যাছাই করা। নিকাহ রেজিস্টার খতিয়ে দেখা, সন্তান প্রসব ও প্রসূতি মায়ের প্রকৃত বয়স নির্ধারণ করা, জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, জাতীয় পরিচয়পত্রের আওতায় উপযুক্ত বয়সী লোকদের নিয়ে আসা, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রতিপালন করাসহ অতীতের কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাল্যবিয়ের গতিকে থামাতে আবারো ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
জাহাঙ্গীর সেলিম : মানবাধিকার কর্মী, লেখক, বাংলারচিঠিডটকমের সম্পাদক